ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

‘কাঠগড়ায়’ ৯ পুলিশকর্তা

আমাদের সময় ::

কক্সবাজারের আলোচিত ৯ লাখ ৯০ হাজার পিস ইয়াবা আত্মসাতের ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটি। কমিটি মোট ১২ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। তাদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ড. একেএম ইকবাল হোসেন, দুই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ডিবির তৎকালীন ওসিসহ ৯ কর্মকর্তা ও ৩ কনস্টেবল।

পুলিশের এই কর্মকর্তারা বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধারের পর বিক্রির সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর ফলে ‘কাঠগড়ায়’ দাঁড়াতে হচ্ছে এই পুলিশ কর্মকর্তাদের। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আমাদের সময়ে ‘৭ লাখ ইয়াবা ৮ কোটিতে বিক্রি’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসনে। পুলিশ সদর দপ্তর ও কক্সবাজার জেলা পুলিশ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে চার মাসব্যাপী দীর্ঘ তদন্তে ঘটনার আদ্যপান্ত উঠে এসেছে। তদন্ত কমিটি পৃথক দুটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে। এ বিষয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ৫৩ সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার পাশাপাশি ভিডিও ফুটেজ, অডিও রেকর্ড, মোবাইল ফোনের ক্ষুদেবার্তা, কল রেকর্ড, মামলার জব্দ তালিকা, অভিযোগপত্র, এমই-এর কপি (সাক্ষ্য স্মারক), চূড়ান্ত আদেশ ও ভিজিটিং কার্ড দালিলিক প্রমাণ হিসেবে প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন কক্সবাজার জেলার এসপি ড. একেএম ইকবাল হোসেন, উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা, কক্সবাজার সদরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল, জেলা ডিবির তৎকালীন ওসি মো. মনিরুল ইসলাম, পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র সরকার, এসআই মো. কামাল হোসেন, এসআই মো. মাসুদ রানা, এসআই মো. জাবেদ আলম, এএসআই মো. মাসুম মিয়া তিতাস, কনস্টেবল মো. মোবারক হোসেইন, মো. রুবেল হোসেন ও মো. কেফায়েত উল্লাহ।

২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সদরের উত্তর লসূরী গ্রামের আবদুল কাদেরের বাগানবাড়ি থেকে ১০ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। পরদিন মাত্র ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে একটি মামলা করা হয়। উখিয়ার জয়নাল মেম্বারের মাধ্যমে কয়েক চালানে বাকি ইয়াবাগুলো বিক্রি করা হয়। আত্মসাৎ করা ইয়াবা বিক্রির ৮ কোটি টাকা পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার এসপি ড. একেএম ইকবাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, যে পরিমাণ ইয়াবা দেখিয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, ওইটার নিরিখেই মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি অন্য যে সব তথ্য পেয়েছে, সে বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।

পুলিশের করা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১০ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধারের পরপরই তৎকালীন ডিবির পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র ও এসআই বশির আহম্মেদ স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে এসপি ইকবাল হোসেনকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাত্র ১০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ দেখিয়ে করা মামলার তদন্ত শেষ করা হয়। রহস্যজনক কারণে এসপি ত্রুটিপূর্ণ মামলাটি আদালতে চার্জশিট দাখিলে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। তদন্ত কর্মকর্তা প্রকৃত ঘটনাস্থল, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী এবং জব্দ তালিকার সাক্ষ্যগ্রহণের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার পরও নীরব থেকে ইয়াবা আত্মসাতের বিষয়টি ধামাচাপা দেন তিনি। ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনার সঠিক তদন্ত থেকে বিরত থেকে বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন এসপি, যেটি পেশাগত অসদাচরণ বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ওসির মাধ্যমে কোনোও নির্দেশনা দেননি। বিধি মোতাবেক মামলাটির তদারকিও করেননি তিনি। মামলাটির ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্রের কারণে আসামিদের খালাস পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে পেশাগত দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন, যা প্রমাণিত হয় অসদাচরণ হিসেবে। একইভাবে সদরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এমই দাখিল করলে তা যাচাই-বাছাই না করেই অগ্রগামী করেন। তার নির্লিপ্ততায় ১০ লাখ পিস ইয়াবা মাত্র ১০ হাজার পিস দেখিয়ে করা মামলার ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্র দাখিল করা সম্ভব হয়। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে তিনি অবহেলা বা অদক্ষতার পরিচয় দিয়ে শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডিবির তৎকালীন ওসি মনিরুল ইসলাম অভিযান পরিচালনাকারী এসআই কামাল হোসেনকেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। কামাল হোসেন ত্রুটিপূর্ণ দুটি দায়সারা অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। সাক্ষীদের জবানবন্দি সঠিকভাবে না নিয়ে মনগড়া জবানবন্দি রেকর্ড করেন। ফলে মামলার তদন্তের সব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় তার ওপর বর্তায়। ডিবির তৎকালীন এসআই বশির আহম্মেদ ঘটনাটি জানতে চেষ্টা করলে তাকে ম্যানেজ করতে এক লাখ টাকা দিয়ে এসআই মাসুদ রানাকে তার বদলিকৃত কর্মস্থল ফেনী ও ঢাকার বাসায় পাঠানো হয়। টাকা নিয়ে এসআই মাসুদ রানা ও বশির আহম্মেদ দ্বন্দ্বে জড়ালে সেই ঘটনার ফুটেজ ধরা পড়ে আমাদের সময়ের অনুসন্ধানী ক্যামেরায়।

এ ছাড়া অপর এক অভিযানে একটি মাইক্রোবাস জব্দ করা হলেও সেটি তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। ডিবির তৎকালীন পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র কক্সবাজার রেইনবো পার্সেল অফিস থেকে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ একটি ডিপ ফ্রিজ জব্দ করেন। কিন্তু তিনি এ ঘটনায় কোনো মামলা রুজু না করে ইয়াবা ও ডিপ ফ্রিজ আত্মসাৎ করেন।

১০ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ডিবির তৎকালীন এসআই কামাল হোসেন ও মামলাটির বাদী এসআই জাবেদ ঘটনাস্থল থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের কক্সবাজারের হোটেল কক্স টুডের সামনে থেকে দুজন টমটম চালক দিদার ও সেলিম উল্লাহর কাছ থেকে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেন।
প্রতিবেদনে যোগ করা হয়েছে, অভিযানে অংশ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে অপরাধ করেন এএসআই মাসুম মিয়া তিতাস, কনস্টেবল মোবারক, রুবেল হোসেন ও কেফায়েত উল্লাহ।

পাঠকের মতামত: